নুরুল হুদা মুকুট ; সুনামগঞ্জের রাজনীতিক অঙ্গনে এক জীবন্ত কিংবদন্তি
কল্লোল তালুকদার চপল, সুনামগঞ্জ ঃ তৎকালীন ছাত্রনেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতা, সাক্ষাৎকার, কলেজ ম্যাগাজিন, সংকলনসহ বিভিন্ন দলিল-দস্তাবিজ ঘেঁটে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংক্ষেপে নিম্নে উপস্থাপিত হলো নূরুল হুদা মুকুটের বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনা : ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণ-অভ্যূত্থানের উত্থাল সময়ে স্কুলছাত্র নূরুল হুদা মুকুট তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখা ছাত্র ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।জুবিলী স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে তিনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দিতেন। উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব ও পরের দশকগুলোতে সুনামগঞ্জের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। প্রগতিশীল পরিবারের ছেলেমেয়েরা অভিভাবকদের অনুপ্রেরণায় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হতেন। নিয়মিত কলেজ সংস�দ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো এবং ছাত্র ইউনিয়নের পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নূরুল হুদা মুকুট তাঁর পরিবারের সঙ্গে সুনামগঞ্জের মুক্তাঞ্চল তাহিরপুর থানার তরণ-শ্রীপুর গ্রামে অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর মেট্রিক পাশ করে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং ছাত্র রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন। তাঁর মার্জিত-ভদ্র পরিশীলিত ব্যবহার ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে কলেজ ক্যাম্পাসে তিনি দ্রুত প্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ফলে ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে তিনি সর্বাধিক ভোট পেয়ে বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হন, যদিও আইনি জটিলতার কারণে এই পরিষদটি বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত সাইফুর-বেলায়েত পরিষদ থেকে তিনি পুনরায় সর্বাধিক ভোট পেয়ে সহ-সাধারণ সম্পাদক (এ.জি.এস.) নির্বাচিত হন। নির্বাচিত এই পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের মাননীয় মন্ত্রী জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ। সম্ভাবনাময় তরুণ নূরুল হুদা মুকুট সম্ভবত তখন থেকেই জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের সুনজরে পড়েন। নির্বাচিত ছাত্রনেতারা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান চৌধুরী, সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী, বাবু অক্ষয় মিনিস্টার,গোলাম রব্বানী, নুরুজ্জামান শাহী, ভি.পি. সাইফুর রহমান সামছু, জি.এস. বেলায়েত হোসেন, এ.জি.এস. নূরুল হুদা মুকুট প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু কলেজের উন্নয়নের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করেন। ৭৫-এর ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৭ আগস্ট, ১৯৭৫ সনে সুনামগঞ্জ শহরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশি হামলা হয়। সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ছাব্বির রহমান সোহেল, নূরুল হুদা মুকুট, ওমকার নাথ রায়, অভিজিত চৌধুরী, গোলাম রব্বানী, যুবলীগ নেতা ফখরুল,ছাত্রলীগ নেতা নুরুজ্জামান শাহী, এখলাছুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানসহ যুব ও ছাত্র নেতাগণ। সামন্ত-সেনা শাসিত পাকিস্তানি কাঠামো ভেঙে যাঁদের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রায়ত জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি নূরুল হুদা মুকুটের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ১৯৭৬ সনে আওয়ামী-রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন। এই মহান নেতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে নূরুল হুদা মুকুট ক্রমশ মুজিবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন।প্রথমে তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, পরপর দুইবার জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং ১৯৯৭ সালে সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ খ্রি. থেকে ২০১৬ খ্রি. সনের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত হয়। ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন, বিএনপি-জামাতের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’দর্শন বাস্তবায়নসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সুনামগঞ্জের রাজপথে তিনিই ছিলেন প্রধান সিপাহসালার। ১/১১ নামে খ্যাত জাতীয় সংকটে যখন সংস্কারবাদীরা মাইনাস-টু ফরমুলা কার্যকর করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তখনও তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর আস্থা রেখে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন অসম সাহসিকতায়। এজন্য এই অকুতোভয়, নির্ভীক মুজিবসেনা-নায়ককে সহ্য করতে হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন। এমনকি একসময় তাঁকে হতে হয়েছে ঘর-বাড়ি ছাড়া।
বিএনপি-জামাত যখন সারা দেশে তাণ্ডব শুরু করে, তখনও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সুনামগঞ্জের রাজপথে দৃঢ় অবস্থান নেন এবং এ কারণেই স্বাধীনতা বিরোধীরা এই শহরে তাণ্ডব সৃষ্টির কোনো অবকাশই পায়নি। নূরুল হুদা মুকুট রাজনীতিতে উড়ে এস জুড়ে বসা নন, বরং সুদীর্ঘ রাজনীতিক পথ পরিক্রমায় বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে তিনি এখন গণমানুষের নেতা। তিনি অর্জন করেছেন সুনামগঞ্জবাসীর আস্থা ও ভালোবাসা। কিন্তু মুজিবাদর্শে উৎবুদ্ধ প্রগতিকামী এই নেতার বিরুদ্ধে কিছু সংখ্যক ভূঁইফোড়, সুবিধাভোগী, স্টান্টবাজ, মুখোশধারী, দুর্নীতিবাজ, খলনায়কগণ এক অশুভ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কপটচারী, ধূর্ত এইসব রাজনীতিক তাদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার পথে একমাত্র বাঁধা জননেতা নূরুল হুদা মুকুটকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এই অসৎ উদ্দেশ্যে সেই কুচক্রীমহল এমন কোনো হীন কর্ম নেই- যা তারা করতে বাকি রেখেছে। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, লোকমুখে শুনা যাচ্ছে দলে তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে মনোনয়ন বাণিজ্য-তরীর পালে হাওয়া লেগে তা নাকি ব্যাপকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। রাজনীতিক বিশ্লেষকগণের মতে, এ কারণেই নাকি নৌকার এই করুণ ভরাডুবি। এইসব দুধের মাছিদের কার্যকলাপে দলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। সাংগঠনিক অবস্থা বিপর্যস্থ হয়ে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দল। তাদের এই অপকৌশল ও ভয়াবহ আরতি দেখে কেবলই মনে পড়ে যায় :“ অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই, করুনার আলোড়ন নেই ,পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি, এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”