দিরাইয়ে সহোদর দুই ভাই, চাচা-ভাতিজা, মামা-ভাগিনার পৃথক পিআইসি

মোশাহিদ আহমদ : ২০১৯-২০ অর্থবছরে দিরাই উপজেলাধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামতের লক্ষ্যে পি.আই.সি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) কাবিটা নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই নিজেদের মর্জিমতো মনোনীত করেছে উপজেলা মনিটরিং কমিটি এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির একাধিক সদস্য অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিগুলোকে উপজেলা মনিটরিং কমিটির দুএকজনের পছন্দের প্রতিফলন বলে অভিহিত করেছেন। গত বছর উপজেলা পাউবোর বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এনে আন্দোলনকারী পিআইসি সদস্যরা এবছরও অগ্রাধিকার পেয়েছেন। একই প্রকল্প একাধিক ব্যক্তিকে অনুমোদন, একই পরিবারের দুই ভাই, চাচা-ভাতিজা, ভগ্নিপতি, মামা-ভাগিনাসহ নিকটাত্মীয়দের পিআইসিতে অন্তর্ভুক্তি, এক ওয়ার্ডের লোককে অন্য ওয়ার্ডে প্রকল্প প্রদান করে অনিয়মের ষোলকলা পুর্ণ করা হয়েছে। এরআগে ডিসেম্বরে উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভায় পিআইসি চুড়ান্তকরণে প্রাথমিক বাছাইয়ের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের উপর ন্যস্ত করা হয়। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক চেয়ারম্যানগণ যারযার ইউনিয়নের প্রতিটি প্রকল্পে ২ টি করে পিআইসি জমা দেন। চেয়ারম্যানদের প্রকল্প প্রতি জমাকৃত দুইটি কমিটির মধ্যে উপজেলা কমিটি একটি চুড়ান্ত করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আইওয়াশ বলেই প্রতীয়মান হয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একাধিক চেয়ারম্যান নিজের নামেই ভাগিয়ে নিয়েছেন পিআইসি। আবার অনেকক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের বাছাই করা কমিটিগুলো বাদ দিয়ে পিআইসি অনুমোদন দেয় উপজেলা কমিটি। এছাড়াও উপজেলার রফিনগর ও ভাটিপাড়া ইউনিয়নে বাঁধের কাজ শুরু করার পর কমিটি গঠনে লোকদেখানো গণশুনাণি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। এমন অনিয়মে বঞ্চিত হয়েছেন নীতিমালা নির্দেশিত বাঁধ সংলগ্ন জমির মালিক ও প্রকৃত কৃষক উপকারভোগীরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার হাওর উপ-প্রকল্পে পিআইসি নং- ৬৪ অনুমোদন দেয়া হয় তারাপাশা গ্রামের সৈয়দ আলী হোসেনকে সভাপতি করে গঠিত কমিটিকে। এই কমিটি ব্যাংকে একাউন্ট খুলে এক্সেভেটর মেশিনসহ শ্রমিকদের সাথে চুক্তি করে কাজ শুরু করলে জানতে পারেন, তাদের কমিটি বাতিল হয়ে গেছে। একই গ্রামের সানুর মিয়ার কমিটিকে এই প্রকল্প প্রদান করা হয়। ভুক্তভোগী সৈয়দ আলী হোসেন উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও নিবার্হী কর্মকর্তা মো. সফি উল্লাহ, সদস্য সচিব ও পাউবোর উপজেলা উপ-সহকারি প্রকৌশলী রিপন আলীসহ পিআইসি সভাপতি সানুর মিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পিআইসি নং- ৬৪(ক) তে। তারাপাশা গ্রামের নোমান মিয়াকে সভাপতি করে গঠিত কমিটিতে প্রথমে অনুমোদন দিলেও একইভাবে পরে তা বাতিল করে দেয়া হয় মো. জাকারিয়া হোসেনকে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ নোমান মিয়া এবিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এছাড়াও চাপতির হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ৪, ১১ ও ১১ (ক) প্রথম অনুমোদিত কমিটি পরে বাতিল করে দেওয়া হয়। সরমঙ্গল ইউনিয়নের উগদল হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং-৫ এর সদস্য সচিব ধনপুর গ্রামের মৃত আব্দুল হাসেমের পুত্র আব্দুল ওয়াহিদ, একই প্রকল্পের পিআইসি নং- ৬ এর সদস্য সচিব জালাল মিয়া আব্দুল ওয়াহিদের সহোদর ভাই। এই পিআইসির সভাপতি মস্তফা এনিয়ে টানা ৪ বছর পিআইসির সদস্য সচিব ও সভাপতি হিসেবে আছেন উল্লেখ করে সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী বলেন, আমি বাছাই করে যোগ্যদের সমন্বয়ে যে কমিটিগুলো দিয়েছি, সেগুলো থেকে দেওয়া হয়নি। লোকদেখানোর জন্য আমাদের বাছাই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে বেইজ্জত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেন, বাঁধের সংযুক্ত জমি মালিক ছোবান মিয়ার জমি থেকে বাঁধে মাটি তুলতে হবে, আমি ছোবান মিয়ার জমির মালিকানার কাগজপত্র সংযুক্ত করে দেওয়া কমিটি চুড়ান্ত করেছিলাম। তাকে দেওয়া হয়নি। উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা প্রশ্ন রাখেন চেয়ারম্যান? উপজেলার চাপতির হাওর উপ প্রকল্পের পিআইসি নং- ৫৯ এর সদস্য সচিব খেজাউড়া গ্রামের আব্দুল মালিকের পুত্র কামরুজ্জামান চৌধুরী, কামরুজ্জামানের সহোদর ভাই মনিরুজ্জামান চৌধুরী বরাম হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ৬০ (খ) সভাপতি। চাপতি হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ১১ (ক) সভাপতি আবিদুর রহমান চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাই জয়নুল চৌধুরী পিআইসি নং- ১১ (ক) সদস্য সচিব, জয়নুল হক চৌধুরীর আপন ভগ্নিপতি মতশ্বির আলম চৌধুরী পিআইসি নং- ৩০ (ক) সভাপতি। তাড়ল ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ১৪ (ক) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, নিজ গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দুরত্বে ভাটিধল গ্রামে তাকে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। সিরাজুল ইসলামের আপন ভাতিজা রিপন চৌধুরী পিআইসি নং- ১২ (ক) এর সদস্য সচিব। ভান্ডাবিল উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ৩৩ এর সভাপতি সরাািলতোপা গ্রামের আলাউদ্দিনের পুত্র ফরিদ মিয়া, পিআইসি নং- ৩৩ (ক) এর সদস্য সচিব বাহার মিয়া আলাউদ্দিনের আপন ভাতিজা, এই পিআইসির সভাপতি নায়েব আলী আলাউদ্দিনের আপন ভাগিনী জামাই। বরাম হাওর উপ-প্রকল্প পিআইসি নং- ১৩ (ক) একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, এখানে এলজিইডির পাকা সড়ক থাকার পরেও প্রথমবার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। রফিনগর ইউনিয়নের কালিয়াকোটা হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ২৫ এর সভাপতি শ্যামল বৈষ্ণব ও সদস্য সচিব রুপম মজুমদার খাগাউড়া গ্রামের বাসিন্দা। প্রকল্প এলাকার ৯০ শতাংশ জমি আনোয়ারপুর গ্রামের বাসিন্দাদের হলেও কোন গণশুনাণি ব্যতিত তাদের প্রস্তাবিত কমিটি বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আনোয়ারপুর গ্রামবাসী। ইউনিয়নের নওয়াগাঁও হতে বলনপুর পর্যন্ত পিআইসি নং- ৪৬ (ক) সভাপতি ফখরুল ইসলাম ও সদস্য সচিব জিয়াউর রহমান প্রকল্প এলাকা থেকে ৮ কিলোমিটার দুরবর্তী রফিনগর গ্রামের বাসিন্দা। প্রকল্প এলাকায় তাদের জমি নাই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। উপজেলা বরাম হাওর উপ প্রকল্পের ঝুঁকিপুর্ণ বাঁধ তুফানখালি পিআইসি নং- ১ এর সভাপতি ইউপি সদস্য শিমুল মিয়াকে অন্য ওয়ার্ডে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই প্রকল্পে পিআইসি নং- ২ এর সভাপতি প্রকল্প এলাকা থেকে ৫ কিলোমিটার দুরত্বে অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পিআইসি নং- ১৩ (ক) এর সভাপতি আতাউর রহমান ও আব্দুল ছত্তার অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা, বিষয়টি নিয়ে এলাকার লোকজন জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন। এছাড়াও ১৩ (ক) সভাপতি আতাউর রহমান ও পিআইসি নং- ১১ (ক) সভাপতি আবিদুর রহমান সর্ম্পকে আপন মামা-ভাগিনা। কালিয়াকোটা হাওর উপ-প্রকল্পের পিআইসি নং- ৪৬ (ক) সভাপতি ফখরুল ইসলাম ও সদস্য সচিব জিয়াউর রহমান রফিনগর গ্রামের বাসিন্দা হলেও তাদের প্রকল্পটি রফিনগর থেকে ৮ কিলোমিটার দুরত্বে নওয়াগাঁও গ্রামে অবস্থিত। এই চিত্র উপজেলার বেশীরভাগ প্রকল্পেই দেখা গেছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী রিপন আলী বলেন, উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দিয়ে প্রাথমিক বাছাই শেষে পিআইসি চুড়ান্ত করা হয়েছে। অনুমোদন হবার পর কমিটি বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আত্মীয়য়দের সমন্বয়ে কমিটি হওয়ায় এগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।