সারাদেশ

ভাষার মাসে ভাষাসৈনিকে আব্দুর রহিমের বিদায় : সুনামগঞ্জের ষোলঘর কবরস্থানে শায়িত

আল-হেলাল, সুনামগঞ্জ : প্রবীণ শিক্ষক,সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক মু. আব্দুর রহিম আর নেই, (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শতবর্ষী এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বার্ধক্যজনিত রোগে শনিবার সকালে ষোলঘরস্থ নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ ছেলে ৩ কন্যা ও স্ত্রীসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল। মুহম্মদ আব্দুর রহিম শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করতেন। নানা বিষয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। একজন নির্মোহ, নির্লোভ ও আদর্শবান শিক্ষকের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তিনি সুনামগঞ্জ সদরের আলমপুর গ্রামের সম্ম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সনে তিনি সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৮৫ সনে অবসরে যান। তিনি একজন ভাষাসৈনিকও। আবদুর রহীম ১৯২৬ সালে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানার কুরবাননগর ইউনিয়নের অন্তর্গত আলমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আল্হাজ্জ ইবরাহীম আলী মুনশী ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও মরমী গানের গীতিকার। তাঁর মাতা মরহুমা মালিকা বানু ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মহিলা। তিনি ১৯৫১ সালে সিলেটের এম.সি কলেজ থেকে বি, এ পাশ করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক। ব্রিটিশ আমলের শেষ দশক থেকে সুনামগঞ্জের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় পদচারণা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ইসলামী জীবনবোধ সার্বজনীনতা ও মানবিকতা তাঁর রচনায় পরিস্ফুট। তাঁর রচিত প্রকাশিত গ্রন্থাবলি হচ্ছে ১. চোখের জলে হাসি (ব্যঙ্গ কবিতা) ২. বাংলা ভাষা ও বাংলা শিক্ষকের মর্যাদা (প্রবন্ধ) ৩. কুরআন কুঞ্জিকা- ১ম খন্ড (কুরআন শরীফের প্রথম পারা’র কাব্যানুবাদ) ৪. মনযিলে মকসুদ (কাব্য) ৫. ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য (প্রবন্ধ) ইত্যাদি। অপ্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ১. পাচঁ মিশালী (কাব্য) ২. সৃজন বেদন (গল্প সংকলন) ৩. জালালাবাদ (কাব্য) ৪. সিলেটের কীর্তিমান সন্তান মুনাওওয়ার আলী (দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ রচিত গঁহধিিধৎ ধষর : অহ ওষষঁংঃৎরড়ঁং ংড়হ ড়ভ ংুষযবঃ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ), ৫. আমার ভুবনে আমি (আত্মকথা)। তিনি বিভিন্ন সময় সম্পাদনা করেছেন ১.দিশারী (হস্তলিখিত মাসিক পত্রিকা- ১৯৪৮-৪৯) ২. সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় বার্ষিকী (১৯৫৮-৮৩খ্রি.) ৩. বার্ষিক মহানবী স্মরণিকা (১৯৬১-৬৩খ্রি.) ৪. উন্মোচন (২১ শে ফেব্রæয়ারি সংকলন, ১৯৭০খ্রি.) ৫. সবুজ পাতা (ইসলামী ফাউন্ডেশন দেয়াল পত্রিকা- ১৯৮৯-৯১খ্রি.)। তিনি সুনামগঞ্জের প্রতিথযশা সাংবাদিক আব্দুল হাই এর সাথে যৌথ সম্পাদনায় পাক্ষিক সুরমা (১৯৬২-১৯৭০) পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়াও ১৯৯৮ সালে কাওসার নামে দ্বীনি মাদ্রাসা, সুনামগঞ্জ এর বার্ষিকী সম্পাদনা করেন তিনি। তার সম্পাদিত বইগুলো হচ্ছে ১. মুহসীন (স্মারকগ্রন্থ, উপদেষ্টা) ২. এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব মুনাওওয়ার আলী (স্মারকগ্রন্থ- ২০০৭খ্রি. আহবায়ক- সম্পাদনা বোর্ড, সম্পাদক- সরকার শাহাব উদ্দিন আহমদ) ৩. কালের দর্পণে, সাংবাদিক রাজনীতিবিদ মকবুল হোসেন চৌধুরী (স্মারকগ্রন্থ- ২০০৮খ্রি. উপদেষ্টা, সম্পাদক- সালেহ চৌধুরি) ৪. চরমহল্লার ইতিবৃত্ত (সম্পাদক, রচিয়তা- মোঃ আবদুল্লাহ)। একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে ২০০২ সালে সিলেটে,গুণীজন হিসেবে একই বছরে আলমপুর সমাজকল্যাণ সংস্থা সুনামগঞ্জ,প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে ২০০৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন,ভাষা সৈনিক হিসেবে ২০০৫ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সুনামগঞ্জ জেলা শাখা,সম্মানিত জীবন সদস্য হিসেবে ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট, একই বছরে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য (ব্রিটিশ সুনামগঞ্জ এডুকেশন্যাল প্রমোশন) বিসেফ, বিশিষ্ট কবি ও ভাষা সৈনিক হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সুনামগঞ্জ জেলা শাখা, ২০০৮ সালে প্রবীণ শিক্ষক ও সাহিত্যিক হিসেবে আলী ফরিদ ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ, সাহিত্যে অবদানের জন্যে ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন সিলেট ও সিলেট লেখক ক্লাবের ২৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি তাকে সংবর্ধনাসহ সম্মাননা প্রদান করা হয়। রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন,সিলেট কর্তৃক ২০১১ সালে ২১শে সম্মাননা ও ২০১২ সালে তিনি জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের শিক্ষক সম্মাননা পেয়েছিলেন। আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা ও বর্তমান ষোলঘর নিবাসী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক,গবেষক, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক মু. আব্দুর রহিম মরহুমের ১ম নামাজে জানাযা শনিবার বাদ জোহর আলমপুরে এবং ২য় জানাযার নামায বাদ আসর ষোলঘর কলোনী স্টেডিয়াম মাঠে অনুষ্টিত হয়। এতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি অংশ নেন। মরহুমের নামাজে যানাজায় বিশিষ্ট লেখক সাহিত্যিক এডভোকেট আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন,বিশিষ্ট লেখক কলামিস্ট এডভোকেট হোসেন তওফিক চৌধুরী,জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট খায়রুল কবির রুমেন,সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মুনাওর আলী, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সেক্রেটারী নুরুর রব চৌধুরী,জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সাধারন সম্পাদক এডভোকেট শেরেনুর আলী,আওয়ামীলীগ নেতা জুনেদ আহমদ,সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট আবুল হোসেন,কুরবাননগর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বরকত,জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আকবর আলী,সাধারন সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরুল,সদর থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক সেলিম উদ্দিন আহমদ,বিএনপি নেতা নাদের আহমদ, ছাতক পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী,আওয়ামীলীগ নেতা শামীম আহমদ চৌধুরী,আলহেরা জামেয়া মাদ্রাসা সুপার আবুল কালাম, সহ-সুপার তোফায়েল আহমদ খান,দারুল হুদা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আনোয়ার হোসেন,দ্বীনি সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক মোমতাজুল হাসান আবেদ,মতিউর রহমান ও লেখক সিরাজুল হক ওলিসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণীপেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও হাজার হাজার সাবেক শিক্ষার্থীবৃন্দ অংশগ্রহন করেন। তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা ও তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। সকলে বলেন, আব্দুর রহিম স্যারের মতো এরকম একজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ,আদর্শবান এবং নিরহংকার ব্যক্তিত্ব সমাজে বিরল।

Related Articles

Back to top button
Share via
Copy link
Powered by Social Snap