জাতীয়সারাদেশ

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী আজ

কলম শক্তি ডেস্ক ঃ বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানটি পহেলা ফাল্গুনে দিনভর নানা অনুষ্ঠানে বাজানো হয়েছে। আজ ২ ফাল্গুন (১৫ ফেব্রুয়ারি) অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইব্রাহীম আলী ও মাতার নাম নাইওরজান। অভাবের সংসারে জন্ম তাঁর; নুন আনতে যেন পান্তা ফুরায়। পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একমাত্র ছেলে; বাকিরা মেয়ে। দিনমজুর বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় শাহ আব্দুল করিমের ছেলেবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে। ফলে কোনো স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি তিনি। যে বয়সে তাঁর স্কুলে থাকার কথা, সে বয়স তাঁকে কাটাতে হয়েছে গরু রাখার কাজে। একটা সময় তাঁকে বাধ্য হয়ে গরু রাখার চাকরিও নিতে হয়েছিল। কিন্তু ছোটবেলা থেকে সংগীতের প্রতি একটি ঝোঁক তাঁকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। মাঠে গরু চরানোর সময় তাঁর হাতে থাকত একতারা। এই একতারাতেই সুর তুলে আপন মনে গেয়ে যেতেন। কিন্তু কেউ কি জানত গ্রামের সেই রাখাল ছেলে একদিন দেশের বাউলসম্রাট উপাধি পেয়ে দেশে-বিদেশে এতটা খ্যাতি অর্জন করবে। শাহ আব্দুল করিমের ছোটবেলায় পাড়া গাঁয়ে লেখাপড়ার কোনো পরিবেশ ছিল না। গ্রামে ছিল না স্কুল-কলেজ। আর দরিদ্র হলে তো কথাই নেই। লেখাপড়া ছিল একেবারেই অসম্ভব। তিনি ১৫ বছর বয়সে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে যে নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, সেটিও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর ভর্তির আট দিনের মাথায়। অন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হবেন সে সুযোগও হয়নি। ফলে এই অক্ষরজ্ঞানই ছিল তাঁর একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে তিনি ছোটবেলাতেই গানের তামিল নিতে ভুল করেননি। তাঁর গানের ওস্তাদ ছিলেন করম উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন ও শাহ ইব্রাহিম মাস্তান। মাত্র আট দিনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা এ বাউল শিল্পী তাঁর তিরানব্বই বছরের জীবনে দেড় হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন; করেছেন সুরারোপ। তাঁর গানগুলো প্রথম দিকে শুধু ভাটি বাংলায় জনপ্রিয়তা পেলেও কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এখন দুই বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ) তাঁর গান সমান জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা শিল্পী নতুন করে আব্দুল করিমের গান গেয়ে শুধু জনপ্রিয়তাই পাননি, এই গানগুলোকে দেশে-বিদেশে করে তুলেছেন ব্যাপক পরিচিত। শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’, ‘কোন মেস্তুরি নাও বানাইলো’, ‘গাড়ি চলে না চলে না’, ‘আমি কুল হারা কলঙ্কিনী’, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’, ‘আমি এই মিনতি করিরে’, ‘রঙের দুনিয়া আর চাই না’, ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমি শাহ আব্দুল করিমের দশটি গান ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছে। তাঁর লিখিত প্রতিটি গানের কথায় যেমন ফুটে উঠেছে ভাটি বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা, তেমনি তিনি কলম ধরেছেন তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গান লিখতে গিয়ে অনেক সময় তিনি মৌলবাদীদের আক্রোশের শিকারও হয়েছেন। এ সময় তিনি অত্যাচারিত হয়ে গ্রাম ছেড়েছেন; কিন্তু গান ছাড়েননি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে শুরু, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সর্বশেষ ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালিদের দাবি আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তাঁর রচিত গান দেশের মানুষকে আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। শাহ আব্দুল করিমের জীবন কেটেছে উজানধল গ্রাম ও কালনী নদীর তীরে। এই মরমি শিল্পী আমাদের জন্য যেসব কালজয়ী সৃষ্টি রেখে গেছেন, তা আজও এ দেশের মানুষকে আন্দোলিত করে। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর সৃষ্ট গানগুলো এ দেশের সংগীতকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর গানে যেমন রয়েছে নতুনত্ব, তেমনি রয়েছে শরিয়তি, মারফতি ও দেহতত্ত্বের মতো দার্শনিক দিক। প্রতিটি গানে আছে প্রেম, বিরহ ও পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে তিনি সহজ-সরল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন গানে গানে। যেমন ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম/ হিন্দু বাড়িনত যাত্রা গান হইত/ নিমন্ত্রণ দিত, আমরা যাইতাম/ আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/ বর্ষা যখন হইতো/ গাজির গাইন আইতো/ রং ঢংয়ে গাইত, আনন্দ পাইতাম/কে হবে মেম্বার, কে গ্রাম সরকার/ আমরা কি তার খবর নিতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ দিন হতে দিন আসিতেছে কঠিন/ করিম দীনহীন, কোন পথে যাইতাম।’ গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, আর চাওয়া-পাওয়ার কথা এভাবে তুলে এনেছিলেন তিনি তাঁর গানে। প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা খাতুন ছিলেন তাঁর গানের প্রেরণা।’

Related Articles

Back to top button
Share via
Copy link
Powered by Social Snap