দিরাইয়ে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্মবার্ষিকী পালন

মোশাহিদ আহমদ, দিরাই : বাংলা বাউল গানের কিংবদন্তি মহাজন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী দিরাইয়ে পালিত হয়েছে। শনিবার দিনব্যাপি বাউল সম্রাটের জন্মমাটি উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজান ধল গ্রামে তাঁর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, কেক কাটা, আলোচনা সভা ও করিম গীতির আসর অনুষ্ঠিত হয়। বাউলের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে দিবসের সুচনা করেন করিমপুত্র শাহ নুরজালাল। এরপর বিভিন্ন সামজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। জোহরের নামাজের পর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বেলা ৪ ঘটিকায় জন্মদিনের কেক কাটা হয়। এরপর শাহ আব্দুল করিম পরিষদের সভাপতি, বাউল পুত্র শাহ নুরজালালের সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতি কর্মী আপেল মাহমুদ ও জয়ন্ত কুমার সরকারের যৌথ সঞ্চালনায় নিজ বাড়ীতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমির বিশ্বাস, জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা পাল, দিরাই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুল হালিম, ইউআরসি নজরুল ইসলাম, প্রেসক্লাব সহ সভাপতি সোয়েব হাসান প্রমুখ। সন্ধ্যার পরথেকে শুরু হয় করিমগীতির আসর, চলে মধ্য রাত পর্যন্ত। উল্লেখ্য, অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইব্রাহীম আলী ও মাতার নাম নাইওরজান। অভাবের সংসারে পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। দিনমজুর বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় শাহ আব্দুল করিমের ছেলেবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি তিনি। জীবিকার তাগিদে গরু রাখাল ও মুদি দোকানে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকে সংগীতের প্রতি একটি ঝোঁক তাঁকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে একদিন দেশে-বিদেশে খ্যাতি এনে দেয়। বাউল সম্রাট উপাধিতে ভূষিত এই সাধকপুরুষ পরবর্তীতে একুশে পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা অর্জন করেন। স্বশিক্ষিত এই বাউল শিল্পী তাঁর তিরানব্বই বছরের জীবনে দেড় হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন; করেছেন সুরারোপ। তাঁর গানগুলো প্রথম দিকে শুধু ভাটি বাংলায় জনপ্রিয়তা পেলেও কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে বহু শিল্পী খ্যাতি অর্জন করেছেন। শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’, ‘কোন মেস্তুরি নাও বানাইলো’, ‘গাড়ি চলে না চলে না’, ‘আমি কুল হারা কলঙ্কিনী’, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’, ‘আমি এই মিনতি করিরে’, ‘রঙের দুনিয়া আর চাই না’, ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমি শাহ আব্দুল করিমের দশটি গান ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছে। তাঁর লিখিত প্রতিটি গানের কথায় যেমন ফুটে উঠেছে ভাটি বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা, তেমনি তিনি কলম ধরেছেন তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, আর চাওয়া-পাওয়ার কথা এভাবে তুলে এনেছিলেন তিনি তাঁর গানে। প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা খাতুন ছিলেন তাঁর গানের প্রেরণা।’