করোনা এবং আমাদের সমাজ – রুদ্র মিজান

আমাদের বিটের এক সহকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার ঘনিষ্টজন। বিষয়টি আজই নিশ্চিত হওয়া গেছে। জানার পর কষ্ট পাচ্ছি। তবে হতাশ হচ্ছি না। বিশ্বাস করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। আপনার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে তিনি কে? জানা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন- ভাইরাসটি যেহেতু ছোঁয়াছে আপনি তার সংস্পর্শে গিয়ে থাকলে আপনার কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রয়োজন। যেভাবে তার পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন। এটি চিকিৎসার একটি অংশ। যদি আপনি না জানেন এবং আপনি তার সংস্পর্শে গিয়ে থাকেন তাহলে আপনার মাধ্যমে আরও অনেকেই আক্রান্ত হবেন। সেটি ঘটবে আপনারই অজান্তে। অথচ আমি আমার সহকর্মীর নাম বলতে পারছি না। এক্ষেত্রে আমি তার অনুমতি চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, সামাজিকভাবে মানুষ এটি ভালোভাবে দেখবে না। তাই নাম, পরিচয় গোপন করাই ভালো। হ্যাঁ সমাজ। এই সমাজ আপনাকে-আমাকে-তাদেরকে নিয়েই। করোনা একটি রোগ। যে কারো হতেই পারে। অথচ রোগীকে আমরা ভালো চোখে দেখবো না। উত্তরার হাসপাতালে যখন রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, আমরা তখন প্রতিবাদ করি। এখানে চিকিৎসা দেয়া যাবে না। করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা গেলে আমরা ধারে-কাছে যাব না। এমনকি তাকে কবর দিতে দেব না। লাশ পড়ে থাকবে দিনের পর দিন। যদিও থাইল্যান্ডের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল সার্ভিসেসের ডিরেক্টর ড. Somsak Akhasilp ব্যাংকক পোস্টকে বলেছেন, হোস্ট (মানব শরীর) মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের ভেতরে থাকা ভাইরাসেরও মৃত্যু ঘটে। সে আর বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। এখন পর্যন্ত পাওয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিশ্চিত হয়েছে করোনাক্রান্ত লাশের শরীর থেকে ভাইরাস বাতাসে এমনি এমনি ছড়িয়ে পড়ে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবেই বলেছে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ থেকে অন্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হ্ওয়ার একটি ঘটনাও ঘটেনি। আমাদের সমাজ এমনই। মুখে মুখে ধর্মের কথা। ধর্মের লেবাশ। নামায পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে। ধর্মটা নিজের সুবিধা অনুসারেই ব্যবহার করে বেশিরভাগ ব্যক্তি। নতুবা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করতে একটি খাটিয়া জুটেনি কেন। তার অপরাধ করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মারা গেছেন? ওই গ্রামেতো প্রায় সবাই মুসলমান। এরমধ্যে মৃত ব্যক্তির স্বজন ছাড়া কী একজনও মানুষ ছিলো না? এই যে শুরুতেই আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা বীরের মতো দেশে ফিরলেন। জমিদারপুত্ররা কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন না। যথাযথ সুবিধা নেই। যদিও সত্য, সরকারের কর্তারা গলাবাজি করে দেশকে সিঙ্গাপুর বানিয়েছেন শুধু কার্যক্ষেত্রে কাজীর গরুর মতো কিতাবে আছে বাস্তবে নেই। যাই হোক, নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য প্রবাসীদের অন্তত সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থাকা উচিত ছিলো। তারা তা করেননি। জোর করে রাখা হলে কেউ জানালা ভেঙ্গে পালিয়েছেন। কেউ ধুমধাম করে বিয়ে করেছেন। ছড়িয়ে গেছেন সারা দেশব্যাপি। করোনা ছড়িয়ে গেছে ঢাকা, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র। লকডাউনের আগে ছুটি পেয়ে লঞ্চ, গাড়ি বোঝাই করে বাড়িতে গেলাম সবাই। যেনো ঈদের ছুটি। লকডাউনে আর্মি দেখতে রাস্তায় নামি আমরা। আড্ডা দিতে গলির সামনে ভিড় করি। এগুলো আছেই। তারপর.. শ্রমজীবী মানুষ। যারা একদিন কাজ না করলে এই সিঙ্গাপুরে না খেয়ে থাকতে হয়। তাদের জন্য সরকার ১০ টাকা কেজি চাল দিচ্ছে। সেই চাল চুরি করছি আমরাই। আমরা যারা নেতা। প্রভাব খাটিয়ে বস্তার বস্তা চাল চুরি করে বিক্রি করে দিচ্ছি। আর আমরাই করোনা রোগী দেখলে তার পাশে দাঁড়াবো দূরে থাক, তাকে মারধর পর্যন্ত করছি। এমন ঘটনা প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন সংবাদে। এসব দেখছি আর হতভম্ব হচ্ছি প্রতিনিয়ত। এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নাগরিক সবার আচরণ কী বৈচিত্র্যময়। করুন, কঠিন। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের কথা বলার কিছুই নেই। তারা কতোটা দায়িত্বশীল তা নিজেরাই ‘ফ্রুটিকা’ মার্কা কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন বারবার। কিন্তু আমরা! আমরা নিজেরাইতো এই দুঃসময়েও মানুষ হতে পারিনি। #
লেখক- রুদ্র মিজান, স্টাফ রিপোর্টার,দৈনিক মানবজমিন