আপনার চেষ্টায় বাঁচিলে প্রাণ, তবেই আপনি মানব-মহান
মিজানুর রহমান পারভেজ :: সৃষ্টিকর্তার এক বিস্ময়কর দান ‘রক্ত’। মানুষের জীবন রক্ষায় রক্তের কোনো বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার এ বিকল্পহীন একধরনের তরল যোজক কলা তৈরির মানব শরীর ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উৎসও নেই। ফলে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করতে হয় কোটি কোটি মানুষকে। বিশ্বে অনেক আগে থেকেই রক্তদান শুরু হলেও বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৭২ সালে।দেশের প্রবীণ রক্তসঞ্চালনবিদ প্রফেসর ডাক্তার মুজিবুর রহমানের তত্বাবধানে ১৯৭২ সালের ১০জুন জাতীয় অধ্যাপক ডাঃনুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সূচনা করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে রেডক্রস (পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি)শুরু করে তার ব্লাড ব্যাংক কার্যক্রম। বিশ্বে প্রতি বছর ১০ কোটি ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু প্রয়োজন অনেক বেশি।বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রক্ত না পেয়ে মারা যান প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ। প্রয়োজনীয় রক্তের ৩৫-৪০ ভাগ পাওয়া যায় রোগীর নিকট আত্বীয়দের কাছ থেকে, ১৫-২০ ভাগ স্বেচ্ছাসেবী থেকে ও ১৫-২০ ভাগ পেশাদার রক্ত বিক্রেতা থেকে। তারপরও বাকি ২০-২৫ ভাগ বা প্রায় ২.৫ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থেকে যায়। অন্যদিকে পেশাদার বিক্রেতারা যে ১৫-২০ শতাংশ রক্তের যোগান দেন তা অনিরাপদ। ফলে ঘাটতি ও অনিরাপদ রক্তের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বা প্রায় ৫ লাখ ব্যাগ। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এর মধ্যে কিছু কেন্দ্রে হেপাপাইটিস বি-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মধ্যে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, সন্ধানী ও রেড ক্রিসেন্ট অন্যতম। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রীক হওয়ায় তৃণমূলে রক্তের ঘাটতি থেকেই যায়।রক্তের ঘাটতি থাকার প্রধান কারণ আমাদের অসচেতনতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে ৪৫ ভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন আর বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি হাজারে মাত্র তিনজন রক্ত দেন। বাংলাদেশে ঘাটতি পূরণ ও অনিরাপদ রক্তের ব্যবহার বন্ধ করতে বর্তমানের চেয়ে বছরে মাত্র ৫ লাখ ব্যাগ অতিরিক্ত সংগ্রহ করতে হবে। একজন সুস্থ ব্যক্তি বছরে তিন বার রক্ত দিতে পারেন। এ হিসাবে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আর মাত্র ২ লাখ মানুষকে স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা হিসেবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে। দেশে বর্তমানে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ তরুণ সম্প্রদায় এবং এদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য পরিমাণও যদি সচেতন করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সংগঠিত করা যায় তাহলে নিরাপদ রক্তসঞ্চালনের ঘাটতি দূর হওয়া কঠিন কিছু নয়। অনেক উন্নত দেশ চাকরিজীবীদের রক্ত দিতে বাধ্য করে তার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে সেটি হয় না। সে কারণে তরুণদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী প্লাটফর্ম গড়ে তোলা প্রয়োজন। জেলা/উপজেলাভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো করে রক্ত সরবরাহে কাজ করলে রক্তের অভাবে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ্যযোগ্যহারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করে রোগীদের ভবিষ্যৎ জীবন ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে। না হলে আপনি-আমি বা আমাদের নিকটজন এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নই। আশারকথা এইযে,আমাদের দিরাই উপজেলাতে কিছু সংখ্যক তরুণদেরকে সংগঠিত করে “স্বজন”রক্তদান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং “দিরাই রক্তদাতা সংগঠন” নামে দুটি সংগঠন রয়েছে।যারা কিনা স্বেচ্ছায় রক্তদান করছে এবং একই সাথে রক্তদানে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। আসুন আমরাই এই ৫৫ হাজার মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করি। ‘আপনার চেষ্টায় বাঁচিলে প্রাণ, তবেই আপনি মানব-মহান’।