বিশেষ কলাম

দেশপ্রেমের প্রজ্জ্বলিত মশাল বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান

মোশাহিদ আহমদ:: মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করেছিলেন বলেই মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। মন্তব্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের। যুদ্ধের ৫ বছর আগে পাকিস্থান আর্মিতে যোগদান করেছিলেন তিনি। চাকুরীকালীন সময়েই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সহকর্মী বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে নিজেকে আলাদা মর্যাদায় আসীন করেন। তিনি শুধু নিজে যুদ্ধ করেননি বরং রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনার গুরু দায়িত্বও পালন করেছেন। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’ এই প্রত্যয় ব্যক্তকারীদের একজন ফজলুর রহমান সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার দিরাই পৌর সদরের চন্ডিপুর গ্রামের কৃতি সন্তান। বর্তমানে পৌরসদরের দুই নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব দিরাই এলাকায় সপরিবারে বসবাস করছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনীর এক সিংহ পুরুষের নাম ফজলুর রহমান। কথোপকথনে জানালেন যুদ্ধকালীন কিছু স্মৃতিকথা। ১৯৬৭ সালে পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। আর্মি অর্ডিন্যান্স কোর’র কর্পোরাল পরে জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হন তিনি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েই পাকিস্থানীদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্থান অনেক এগিয়ে থাকলেও পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্থানীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্থানীদের সংখ্যা ছিলো খুব কম। শুধু সেনাবাহিনী নয় প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই অসঙ্গতি, সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে তুলনামূলক বঞ্চিত হচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্থানীরা। এগুলো পীড়া দিত ফজলুর রহমানকে। মনে ক্ষোভ দানা বাধেঁ। এতে প্রকাশ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৬৮ সাল। ঘটনাস্থল করাচির মালিক ক্যাম্প ডিপো। তখন সেনাবাহিনীর মাসিক দরবার চলছিলো। ওই সময়ে পাকিস্থানী সেনাকর্মকর্তাদের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে একটি আবেদন করেন ফজলুর রহমান। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্থান থেকে সেনাবাহিনীতে সৈনিক নিয়োগের আবেদন জানান এই সৈনিক। ওই ইউনিটের বাঙালি কর্মকর্তা এবং সৈনিকরা সেদিন অবাক হন তাঁর সাহসিকতায়। কিন্তু তার আবেদন জমা দেয়ার পরপরই কৌশলে দরবার মূলতবি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে বাঙালি অন্যান্য সৈনিকরা ফজলুর রহমানকে উৎসাহ দিয়েছেন। গোপনে বাঙালি সেনাদের উদ্বুদ্ব করেছেন মুক্তি সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এভাবেই যেন করাচির দরবার হলে প্রথম যুদ্ধের সূচনা করে দেশপ্রেমের মশাল প্রজ্জ্বলিত করেন ফজলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ফজলুর রহমান ছুটিতে ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। করাচি যাওয়ার পথে ঢাকা ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান নেন। অনুভূত হচ্ছিল পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল হচ্ছে। এ অবস্থায় করাচি যাওয়া ঠিক হবে কি-না ভেবে পাচ্ছিলেন না। তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে থাকতেন সিরাজুল আলম খান। তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ফজলুর রহমান। সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে ফজলুল রহমান বলেন, ‘দিন-তারিখ মনে নেই। তবে মার্চ মাসের ১৫ তারিখের পরে পরিস্থিতি খারাপ দেখে শেখ সাহেবের সাথে তাঁর বাসায় দেখা করি।’ তিনি তখন বঙ্গন্ধুর কাছে জানতে চান তাঁর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্থানে এই মুহূর্তে তিনি যাবেন কি-না? বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আমরা যদি ক্ষমতা না পাই তাহলে আপনাদের চাকরি থাকবে না। আমরা ক্ষমতায় গেলে আপনাদের চাকুরি থাকবে। পরিস্থিতি ভালো না। আপনারা ঢাকায় থাকেন। অপেক্ষা করেন। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হবে।’ ফজলুর রহমান জানান, সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পশ্চিম পাকিস্থানীদের প্রতিদিনের খবর সংগ্রহ করে তাঁকে জানাতেন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ২৪ মার্চ ধরা পড়ে যান তিনি। পাকিস্থানী আর্মিরা তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে জোড় করে গাড়িতে তুলে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। সারাদিন তাঁকে দিয়ে বিমানবন্দরে কুলির কাজ করানো হয়। সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয় পাকিস্থানী আর্মিরা। ওই দিন আর সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। তিনি কুর্মিটোলা ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান নেন। ফজলুর রহমান বলেন ‘সেদিন পাকিস্থানী আর্মিরা যদি আমার পরিচয় পেতো তাহলে জীবিত থাকতাম কি-না জানিনা।’ ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়াটারে হামলা চালায় পাকিস্থানী আর্মিরা। ফজলুর রহমান বলেন ‘তখন আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ি। কি করবো ভেবে পাই না। পরদিন কোনোক্রমে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পাশ্ববর্তী শেওড়া গ্রামে যাই।’ ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘ভাবছিলাম বাড়িতে (সিলেট) চলে যাব। ওইখানে স্থানীয়দের সাথে কথা হয়। নারী-পুরুষ সবাই অনুনয় করে- আপনারা আর্মি হয়ে যদি বাড়িতে চলে যান। তাহলে আমাদের কী হবে?’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে শুনতে পাই মেজর জিয়া সাহেব বিদ্রোহ করেছেন। তখন প্রচন্ড সাহস পাই।’ ওই সময়ে তিনি জানতে পারেন সেনাবাহিনীর চার নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণ বাড়িয়া থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করেন সেখানে যাবেন। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে যান নরসিংদী, পরে নরসিংদী জেলা সদরের জলিল নামক আওয়ামী লীগের এক নেতা তাঁকে চার নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে দেন। সেখান থেকে ওই রেজিমেন্টের সৈনিকরা হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় জড়ো হন। তেলিয়াপাড়া থেকে ভারতের আর্মিদের সহযোগিতায় চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে রামগড় হয়ে চট্রগ্রাম পৌঁছেন ফজলুর রহমানসহ ৪২ জনের একটি মুক্তিকামী সশ্রস্ত্র দল। এদের মধ্যে ৩৯ জনই ছিলেন সেনাবাহিনীর সৈনিক বাকি তিন জন ছিলেন তৎকালীন বিডিআর’র সদস্য। চার নম্বর রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (পরে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল)। তার বাড়ি মৌলভীবাজারে। সেক্টর হওয়ার পর দুই ও পাঁচ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন ফজলুর রহমান। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে প্রথম যুদ্ধ করেন চট্রগ্রাম টিবি হাসপাতাল এলাকায়। তার আগে পর্যায়ক্রমে চট্রগ্রামের ওয়ারলেস সেন্টার, সীতাকুন্ড, বারবকু এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন ফজলুর রহমান। চট্রগ্রামে যুদ্ধকালে তাঁর একজন সহযোদ্ধা বিডিআর’র এক সদস্য শহীদ হন। অন্যদিকে অনেক পাকসেনা নিহত হয় তাদের হামলায়। তবে তাঁর প্রথম গেরিলা যুদ্ধ নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়ায়। ফজলুর রহমান বলেন ‘যুদ্ধকালে আমাদের মর্টার পরিচালনার লোকের প্রয়োজন ছিলো। তাই ক্যাপ্টেন মতিন সাহেবের নির্দেশে আমি ভারতের অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টার থেকে তিন ইঞ্চি শিক্ষা গ্রহণ করি।’ তারপর কর্ণেল মীর শওকত আলী’র (পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল) অধীনে পাঁচ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন তিনি। সেখানে সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকায় জয়বাংলা নগরে থেকে মর্টারের যুদ্ধ পরিচালনা করেন ফজলুর রহমান। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানে থেকে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এ দেশের মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যুদ্ধ করেছি। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু আজও আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’ জীবনের শেষলগ্নে দাঁড়িয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনও স্বপ্ন দেখেন, এই দেশ একদিন সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন হবে। নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।

Related Articles

Back to top button
Share via
Copy link
Powered by Social Snap