মোশাহিদ আহমদ, দিরাই :: ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরীর ভরাডুবি হয়েছে। দিরাই পৌরসভার ৯ ওয়ার্ডের ১২ টি কেন্দ্রের অন্ততঃ সাতটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত। দিরাই শাল্লার সাবেক এমপি নাছির উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, পৌর বিএনপির সভাপতিসহ দায়িত্বশীলদের কেন্দ্রেও ঘটেছে বির্পযয়। প্রতিষ্ঠার পর এই পৌরসভায় দিরাই পৌর বিএনপির সভাপতি হাজী আহমদ মিয়া প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০১০ ও ২০১৫ সনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিজয় লাভ করলেও তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মঈনুদ্দিন চৌধুরী। এবারই ব্যতিক্রম, নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী টেনেটুনে জামানত টিকিয়ে রেখেছেন মাত্র। বিএনপির এই বিপর্যয় নিয়ে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মাঝে চলছে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত, ইভিএমের কারসাজি, কালো টাকার প্রভাবকে ভরাডুবির কারণ হিসেবে ব্যাখা করছেন তাঁরা।
এই পৌরসভায় আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে দল মনোনীত বিশ্বজিৎ রায় (নৌকা) বিজয়ী হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোট ৫ হাজার ৯১০। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান মেয়র মোশাররফ মিয়া (জগ) পেয়েছেন ৫ হাজার ৭৫৭ ভোট। বিএনপির ইকবাল হোসেন চৌধুরী (ধানের শীষ) ১ হাজার ৯৬০ ভোট পেয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের রাধানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক ৩৬০ ভোট পেয়েছে। কাছাকাছি ৩৫৪ ভোট পেয়ে জগ প্রতীক রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পড়েছে ১৬১। অথচ ২০১৫ সনের নির্বাচনে মোশাররফ মিয়ার নৌকা প্রতীকে ১৭৬ ভোটের বিপরীতে বিএনপির মঈনুদ্দিন চৌধুরী ৬১৩ ভোট পেয়েছিলেন। এরআগে ২০১০ সালে নির্বাচনেও আওয়ামীলীগের আজিজুর রহমান ১৯৩ ও বিএনপির মঈনুদ্দিন চৌধুরী ৫৩৪ ভোট পেয়েছিলেন। এই ওয়ার্ডের আরেকটি কেন্দ্র রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৌকা ২২৪, জগ ২৬৬ ও ধানের শীষ প্রতীক ১১৬ ভোট পেয়েছে। ২০১৫ সনে এই ওয়ার্ডে নৌকার ১৯৩ ভোটের বিপরীতে ধানের শীষ পেয়েছিল ৪১০ ভোট। ২০১০ সনে এই ওয়ার্ডে আওয়ামীলীগ সমানসংখ্যক ১৯৩ ভোট ও বিএনপি পেয়েছিল ৫৩৪ ভোট।
পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড। উপজেলা বিএনপি সভাপতি কামরুজ্জামানের কেন্দ্র এটি। এই ওয়ার্ডে নৌকা ৫০৪, জগ ৫১৭ ও ধানের শীষ ২১০ ভোট পেয়েছে। ২০১৫ সনের নির্বাচনে নৌকার ৫৬৯ ভোটের বিপরীতে ধানের শীষ ভোট পেয়েছিল ৭২৭ ভোট। ২০১০ সনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ৫২০, বিএনপি ৬৯৬ ভোট পায়।
পৌরসভায় বিএনপির অন্যতম ঘাঁটি ৮ নম্বর ওয়ার্ড। মোট কেন্দ্র দুটি। একটি সাবেক সাংসদ নাছির উদ্দিন চৌধুরীর। অপরটি বিএনপি প্রার্থীর নিজের কেন্দ্র সুজানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদ, উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুর রশীদ বাচ্চুর কেন্দ্রও এটি। এখানে বিএনপি পেয়েছে ৪৬৭ ভোট। এই কেন্দ্রে জগ ২৬১ ও নৌকা ১০৪ ভোট পেয়েছে। ২০১৫ সনে বিএনপির প্রার্থী সুজানগর গ্রামের কেউ না হলেও এখানে নৌকার ২৯১ ভোটের বিপরীতে ধানের শীষ পেয়েছিল ৫৩১ ভোট। ২০১০ সনে নৌকা ২২১, ধানের শীষ ৫২১ ভোট পায়। এই ওয়ার্ডের আরেকটি কেন্দ্র হাজী মাহমদ মিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা। সাবেক সাংসদ নাছির চৌধুরীর এই কেন্দ্রে নজিরবিহীনভাবে ৫১৮ ভোট পেয়ে এবার নৌকা প্রতীক বিজয়ী হয়েছে। এই কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী মোশাররফ মিয়া পেয়েছেন ৩৮৪ ভোট। ৩৮০ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে ধানের শীষ। এই কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে স্মরণকালে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। ২০১০ সনে এই কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের ৩৭৩ ভোটের বিপরীতে বিএনপি ভোট পায় ৯২১। এরপর ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার ২৭৬ ভোটের বিপরীতে ধানের শীষ ১০৮১ ভোট পায়।
বিএনপির আরেকটি ঘাঁটি পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের ভরারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা ৩৬০ ভোট, জগ ৪১১ ভোট ও ধানের শীষে ভোট পড়ে ২৪৪ ভোট। ২০১৫ সনে এই কেন্দ্রে নৌকা ৩৪৫ ভোট ও ধানের শীষ ৭৫৯ ভোট পেয়েছিল। ২০১০ সনে আওয়ামীলীগ ২৮৩ ও বিএনপির ভোট ছিল ৭৩৪। এই ওয়ার্ডের দিরাই সরকারি কলেজ কেন্দ্রে এবারের নির্বাচনে নৌকা ৪১৭, জগ ৩৯৪ ও ধানের শীষ ১৭০ ভোট পেয়েছে। ২০১৫ সনে এই কেন্দ্রে নৌকা ৩৪৫ ও ধানের শীষ ৭৫৯ ভোট পায়। এরআগে ২০১০ সালে আওয়ামীলীগ ৪১১ ও বিএনপি ৫৫৩ ভোট পায়।
এছাড়াও এবারের নির্বাচনে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে ধানের শীষ ২৯ ভোট, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫ ভোট, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ ভোট, ৬ নং ওয়ার্ডে ৭৪ ভোট, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৪ ভোট পায়। ২০১৫ সনে ১ নম্বর ওয়ার্ডে ২০৬ ভোট, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩১২ ভোট, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ২৮১ ভোট, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৪২২ ভোট, ৭ নং ওয়ার্ডে ৫২৮ ভোট পেয়েছিল। এরআগে ২০১০ সালের নির্বাচনেও ১ নম্বর ওয়ার্ডে ধানের শীষ ৩২৪ ভোট, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৯৪ ভোট, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৪১৪ ভোট, ৬ নং ওয়ার্ডে ৩৭৬ ভোট, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৬৪ ভোট পায়।
পৌরসভা নির্বাচনে দলের ভরাডুবি নিয়ে দিরাই উপজেলা যুবদলের সাবেক প্রচার সম্পাদক সুমন মিয়া বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপিকে। জেলা যুবদলের সহকর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক মহিউদ্দিন মিলাদ বলেন, কালো টাকা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদ বলেন, ইভিএমের কারসাজি আর কালো টাকার ছড়াছড়ি বিএনপির ভরাডুবির কারণ। দল মনোনীত প্রার্থী মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি নির্বাচনের শুরুতেই বলেছিলাম ইভিএম নিয়ে শংকায় আছি। তার প্রতিফলন ঘটলো ২৮ তারিখের নির্বাচনে। বিএনপির কেন্দ্রগুলোতে ইভিএমে ভোট কারচুপি হয়েছে। দিরাই পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হল ইভিএম একটি অকার্যকর পদ্বতি।