বিষে ভরা ২০২০, কেমন কেটেছে দিরাইবাসীর
হিল্লোল পুরকায়স্থ :: ২০২১ সাল, নতুন বছর শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করেন গত বছর খুব কষ্টে কেটেছে। এবার হয়ত নতুন বছরটা ভালই কাটবে। আসলেই কি ২০২০ আমাদের জন্য ছিল ‘বিষে ভরা ২০২০’, যাতে রয়েছে অনেক দুঃখ–কষ্টের ইতিহাস। কোথাও কোথাও মানবতা হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। একের পর এক ধারাবাহিক বিপদাপদের ইতিহাস। বলতে গেলে যার অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে, ভয়-আতঙ্ক, অভাব-দারিদ্য ও দুরবস্থার মধ্য দিয়ে। যার ভয়াবহ আতঙ্কের প্রভাব এখন পর্যন্ত কেটে ওঠেনি। তারি ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া আমার জন্মভূমি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় ভাল,মন্দ ঘটনা গুলো খুঁজে তুলে ধরছি।
২০২০ সালের পুরোটা জুরেই ছিল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিধ্বংসী এক বছর। এদেশে ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের তথ্য নিশ্চিত করে সরকার। এদিকে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার।এরপর একে একে সারা বছরে ২০ ডিসেম্বর ২০২০ পযন্ত দিরাইয়ে সর্বমোট ১১৪ জন আক্রান্ত হয় যার মধ্যে সুস্থ হয় ১১২ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ জুলাই উপজেলায় প্রথমবারের মত এক বৃদ্ধ মহিলা কমরুননেছা(৭৫) মৃত্যু হয়। পরে করোনায় আক্রন্ত শৈলেন রায় (৫৫) উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামের সচিন্দ্র রায়ের ছেলে ১৬ জুলাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সিলেট যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। তাছাড়া সরকার ঘোষিত লকডাউনে এলাকার শতশত মানুষ কর্মহীন হয়ে কষ্টে জীবন যাপনের ঘটনাত আছেই।
তারপর যে কথাটা বলতে হয় গত বছর পানিতে ডুবেই মারা যায় ১১ জন তার মধ্যে ৮ জন শিশু ছিল। ২ জন যুবক ও ১ জন বৃদ্ধ। গত বছরের ২৭ জুন উপজেলার উজান ধল এলাকায় কালনী নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর মাটিয়াখাড়া গ্রামের জয়সুন্দর দাস (৫৫) ও তার মেয়ের দিকের নাতি উপজেলার জারুলিয়া গ্রামের রঞ্জিত দাসের ছেলে পৃথম দাস (৯) এর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। রবিবার ১২ জুলাই পৌরশহরের ঘাগটিয়া গ্রামের শমসুন্নুর মিয়ার মেয়ে শুকুরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত ১০ বছর বয়সী সানিয়ার পানিতে ডুবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। জানা যায়, সেদিন বন্যার পানিতে খেলা করতে ঘর থেকে বের হয় সানিয়া। এরপর অনেকটা সময় তাকে দেখতে না পেয়ে তার পরিবারের লোকজন তাকে খুঁজতে বেড় হয়। অনেক খোঁজাখুজির পর বাড়ির পাশের খালের পানিতে ডুবে থাকা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবার ১৬ জুলাই বেলা ৪ টার দিকে উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের নতুন কর্ণগাঁও গ্রামে বানের পানিতে ডুবে মাহফুজা আক্তার নামে ৪ বছরের শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশু মাহফুজা ঐ গ্রামের মুশাহিদ মিয়ার কন্যা ছিল। মঙ্গলবার ৪ আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে মাছের নৌকাতে বেড়াতে গিয়ে নৌকা ডুবিতে শিপলু মিয়া (২০) নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) সকালে উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের তেতৈয়া গ্রামে পানিতে ডুবে সিমি আক্তার( ৯) ও সিমরান আক্তার (৭) নামে দুই বোনের মৃত্যু হয়। জানা যায়, ঐ দিন সকালে বাড়ির পাশে পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল দুই বোন সিমি আক্তার (৯) ও সিমরান আক্তার (৭)। পুকুরে গোসল করার সময় একপর্যায়ে তারা ঘাট থেকে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। দুইজনকে দেখতে না পেয়ে পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করে পুকুর থেকে তাদের উদ্ধার করে মার্কুলী বাজারে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করে। শুক্রবার ১১ সেপ্টেম্বর উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের রফিনগর গ্রামের জরাইন্না খালের পানিতে লাল রংয়ের টিশার্ট ও হাফ প্যান্ট পরিহিত এক অজ্ঞাতনামা শিশুর লাশ পানিতে ভাসতে দেখা যায়।শনিবার ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে পৌরসভার চন্ডিপুর গ্রামে এমরান হোসেন নামে ১৯ মাস বয়সী এক শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। ঐ দিন এমরান কে খেলারত অবস্থায় রেখে তার মা ঘরের ভিতরে যান। কিছুক্ষণ পরে যখন এমরানের মা ফিরে আসেন তখন এমরান কে বারান্দায় না দেখতে পেয়ে খোঁজাখুজি করতে থাকেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বসত ঘর সংলগ্ন ডোবার পানি থেকে শিশু এমরানকে উদ্ধার করে তার পরিবারের লোকজন।এসময় পরিবারের লোকজন শিশু এমরান কে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে। ১৯ অক্টোবর রাজানগর ইউনিয়নের রন্নারচর গ্রামে ডুবার পানি থেকে ৭ বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। সে ঐ গ্রামের চন্দ্রকান্ত সরকারের ছেলে দুর্জয়।বৃহস্পতিবার ১৯ নভেম্বর ভোর সকালে উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের রন্নারচর গ্রামের কালিয়াকুটা হাওরে চিংড়ি মাছ ধরতে গেলে পিন্টু দাস (২৩) পানিতে ডুবে মারা যায়।
গত বছর দিরাইয়ে সংঘটিত বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় তিন জন যুবক , করিমপুর ইউনিয়নের নাগেরগাঁও গ্রামের মুমিন মিয়া (২৭) ও একই গ্রামের ধরণী দাসের ছেলে তারেশ দাস (২৯) মোটরসাইকেল- পিকআপ এর মুখোমুখি সংঘর্ষে দিরাই-মদনপুর সড়কের সুজানগর নামক স্থানে ২৫ জানুয়ারি প্রাণ হারায়। এবং ১১ ফেব্রুয়ারি শরীফপুর নামক স্থানে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় রায়হান (২০) নিহত হয় । সে শরীফপুর গ্রামের আকবর আলীর পুত্র। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের আকিলশাহ বাজার সংলগ্ন আকিলশাহ-হাতিয়া সড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক বৃদ্ধ ইসমাইল মিয়া (৬৫) প্রাণ হারায়া। সে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার সোনাপুর গ্রামের বাসিন্ধা।সেই সাথে দিরাই- মদনপুর সড়কের ছাদিরপুর রাস্তার মোড়ে ২৬ মে দুপুরে লেগুনার ধাক্কায় ১ শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। শিশুটি পাথরিয়া ইউনিয়নের কাশীপুর গ্রামের সোনা মিয়ার পুত্র সানোয়ার (৪)।একই মাসে আবার ২৯ মে রফিনগর ইউনিয়নে অবৈধ ট্রলির চাপায় এক শিশুর মৃত্যু হয়। নিহত শিশু তানজিনা(১০) জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের কান্দবপুর গ্রামের রুপায়েল মিয়ার কন্যা। সেই সাথে দিরাইয়ে বেপরোয়া মোটর সাইকেল চাপায় আহত শিশু হামিম মিয়ার (৮) ১৭ জুলাই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। সে উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের মো. তছর মিয়ার পুত্র।
গত বছর দ্বন্দ্ব নিয়ে সংঘর্ষে উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের নাচনী গ্রামে বাচ্ছাদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে ১ জন নিহত হয়। নিহতের নাম মোঃবকুল মিয়া(২৬)। সে ঐ গ্রামের মোঃ আব্দুস ছত্তারের ছেলে।এছাড়াও বৃহস্পতিবার ১৩ অক্টোবর সকাল ৭ টার দিকে উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মধুরাপুর গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়। নিহতের নাম নুর মোহাম্মদ (৫০ )।
গত বছর ২০২০ সালে উপজেলায় বজ্রপাতে মারা যায় ৩ জন। তারা হলেন, তাপস মিয়া (৩৫) । সে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসূখা গ্রামের মফিজ উল্লার পুত্র। তকবির মিয়া(১৪)। সে উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের লৌলারচর গ্রামের খালেক মিয়ার ছেলে।এছাড়াও রাজানগর ইউনিয়নের রন্নারচর গ্রামের মৃত শুক্কুর আলীর ছেলে তুতন মিয়া(৫০) বজ্রপাতে কালিয়াগুটা হাওরে মারা যান।
গত বছর ঘটে যাওয়া নানা ঘনটার মধ্যে একটি ঘটনা না বল্লেই নয় তা হল উপজেলার বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের শীষ্যের গানের ঘরে আগুন।দেশ যখন করোন সংক্রমণ প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে। ঘরবন্দী হয়ে কর্মহীন হয়ে পরেছে সাধারণ মানুষ ঠিক সেই মুহূর্তে কর্মহীন হয়ে পড়া বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম শীষ্য রণেশ ঠাকুরের গানের ঘরে দুষ্কৃতীদের দেয়া আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮ মে দিবাগত রাত ১ টায় উপজেলার উজানধল গ্রামে।
২০২০ সালে ঘটে যাওয়া আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ১১ জুলাই পৌরশহরের ভরারগাঁও গ্রামে পিতৃমাতৃহীন ছেলে ১২ বছর বয়সী তায়েফ মিয়া গ্রামের ইলেক্ট্রিশিয়ান শামসুজ্জামানের ফলের গাছ থেকে জাম্বুরা পারতে গাছে উঠে সেই সময় কাছে জাম্বুরা না থাকলে গাছ থেকে ঘরের চালে পা রেখে জাম্বুরা পারতে গেলে তৎক্ষণিক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় তায়েফ। তাছাড়া এই বছর দিরাইয়ে ঘটে গেছে প্রতিবন্ধী কিশোরী ধর্ষণেরমত ঘটনা। লম্পট ধর্ষক উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের গুচ্ছ গ্রামের মারফত মিয়ার ছেলে কাবিল মিয়া (৩৮)।এ ঘটনায় কিশোরীর পিতা বাদী হয়ে ঐ ধর্ষককে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে দিরাই থানা পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। তার সাথে বছরের শেষ মুহূর্তে এসে যোগ হয়েছে দিরাইয়ে চলন্ত বাসে কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ। ঘটনাটি ২৬ ডিসেম্বর দিরাই- মদনপুর সড়কের সুজানগর গ্রামের কাছে ঘটে।
সবশেষে বলা চলে শত কষ্টের মাঝে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে চতুর্থ বারের মত দিরাই পৌরসভায় ২৮ ডিসেম্বর এক জাকজমকপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে প্রথমবার ইভিএমে ভোট দেন দিরাই পৌরবাসী। ১৫৩ ভোটে বিজয়ী হন আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী বিশ্বজিৎ রায়। পৌর নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দিরাইবাসী ২০২০ কে বিদায় জানায়।
লেখকঃ সমাজসেবা অধিদফতরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্পে কর্মরত।