অদম্য ইচ্ছেশক্তিতে এগিয়ে চলেছে অন্ধ মৃত্যুঞ্জয়
নিজস্ব প্রতিবেদক :
দু’চোখে আলো নেই। মনোজ্ঞান ও ইচ্ছেশক্তি দিয়েই চলছে জীবন যুদ্ধ। চোখে না দেখেও প্রায় একযুগ ধরে বাঁশ বেতের বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে চলছে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস (৩০)-এর সংসার। মৃত্যুঞ্জয় আপন হাতে যত্ন নিয়ে বুনে চলেছেন কুলা, চাটাই, চাঙারি, টুকরি, ওড়া, ডালা, চালুনি, মাছ রাখার খালই, ঝুড়ি ও হাঁস-মুরগির খাঁচাসহ বাঁশ বেতের নানা জিনিস। তার এ কাজে সাহায্য করেন বৃদ্ধ পিতা বীরেন্দ্র বিশ্বাস।
মৃত্যুঞ্জয়ের বয়স তখন ১২/১৩ বছর। ওই সময়ে তার দুই চোখে ব্যথা হতো। চোখের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় গরিব পরিবার চিকিৎসা করাতে পারেনি। প্রায় ১৫ বছর আগে চোখের আলো হারিয়ে ফেলেন তিনি।
মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ‘ছোটবেলায় টাকার অভাবে চোখের চিকিৎসা করাতে পারিনি। আর এখন তো চোখের রগ শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার বলছে এখন আর চোখ ভালো হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী। চোখে দেখি না। তবে সৃষ্টিকর্তা আমাকে কাজ করার শক্তি দিয়েছেন। ছোট করে হলেও কাজ করে খেতে পারি। কারও কাছে হাত পাততে হয় না। তাই ভালো আছি।’
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের শৈশব, কৈশোর কেটেছে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের ছায়াঘেরা পুরাতন কর্ণগাঁও গ্রামে। তার পৈত্রিক ভিটেবাড়ি এটি। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ছোটভাই সনঞ্জয় বিশ্বাস দিরাই শহরে একটি মিষ্টির দোকানে চাকুরী করেন। গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ায় স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি তার। অভাবের তাড়নায় ছোট থেকেই কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়েন।
মৃত্যুঞ্জয় বলেন, আমি চোখে না দেখলেও এই বাড়ি-ঘর, বাঁশ বেত আমার চেনা। আমার কাজগুলো আমি করতে পারি। বছরখানেক আগে মৃত্যুঞ্জয় বিয়ে করেন। স্ত্রী আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়েই তার সংসার।
চোখের আলো নেই, তবুও বেত ওঠানো, বুনন এমন জটিল কাজ কিভাবে করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ভিক্ষা করা, মানুষের কাছে হাতপেতে কিছু নেওয়া আমি পছন্দ করি না। চোখের আলো হারিয়ে বিমর্ষ হয়ে পরেছিলাম। তবে হাল ছাড়িনি। কিছু করার অদম্য ইচ্ছা থেকে আজকে এপর্যন্ত এসেছি। কাজ করে খাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। সমাজে সবার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে থাকা যায়।
মৃত্যুঞ্জয়ের পিতা বীরেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ধারালো দা দিয়ে বেত ওঠানোসহ যে কোন ধরনের বাঁশ বেতের জিনিস দ্রুততার সাথে করতে পারে মৃত্যুঞ্জয়। অসহায়ের সহায় তাকে সেই শক্তি দিয়েছেন।
মৃত্যুঞ্জয় নিজের কর্মক্ষেত্র আরেকটু বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখেন। তার তৈরী করা বাঁশ বেতের জিনিস বিক্রির জন্য দিরাই পৌর শহরে একটি দোকান করতে চান তিনি। মৃত্যুঞ্জয় বলেন, পাইকাররা ন্যায্য দাম দেয় না। শহরে নিজের একটি দোকান থাকলে মালের চাহিদা আরও বাড়তো। উপযুক্ত মুল্যও পেতাম। কিন্তু আমার সে সামর্থ্য নেই। সরকার যদি সহযোগিতা করতেন, তবে এই অন্ধের স্বপ্ন পূরণ হতো।