দিরাইয়ে বিদ্রোহীদের চাপে কোণঠাসা নৌকার প্রার্থীরা, বহিষ্কার ৩
মোশাহিদ আহমদ, দিরাই : সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৫৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামীলীগেরই মনোনীত প্রার্থী ৯ জন এবং বিদ্রোহী আছেন ২৬ জন। প্রতিটি ইউনিয়নেই আওয়ামীলীগের একাধিক বিদ্রোহী শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগে এমন প্রার্থীজট নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাঁরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। নেতাদের কথা শুনছেন না কেউ। বিদ্রোহীদের কাছে অনেকটাই অসহায় মনে হচ্ছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে। নেতারা প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করেছেন। তুণমূলে জনপ্রিয় প্রার্থীরা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এই ভুলের খেসারত ভোটের দিনে দিতে হবে।
এদিকে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে গত সোমবার রাতে বিদ্রোহী তিন প্রার্থীকে বহিষ্কার করেছে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ। এঁরা হলেন, তাড়ল ইউনিয়নের তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য আকিকুর রেজা পুলিশ, জগদল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক শিবলী আহমেদ বেগ, ভাটিপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহসভাপতি শাহজাহান কাজী। এছাড়া রফিনগর ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী, জেলা আওয়ামীলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ প্রেরণ করেছে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ। জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক মো. নূরে আলম সিদ্দিকি উজ্জ্বল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, বিগত ইউপি নির্বাচনে মতিউর-সুরঞ্জিত বিরোধ তখন তুঙ্গে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৭টিতে সুরঞ্জিত অনুসারীরা মনোনয়ন পেলেও ২টি ভাগিয়ে নেন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমান। ওই দুই ইউনিয়ন জগদল ও ভাটিপাড়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্দেশে বিদ্রোহী প্রার্থী হন শিবলী আহমেদ বেগ ও শাহজাহান কাজী। নির্বাচনে দুজনই বিজয়ী হন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, এবারের নির্বাচনে উপজেলার নয় ইউনিয়নের ৬টিতে জনসমর্থনের দিক দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীরা অনেকটা এগিয়ে আছেন। করিমপুর, চরনারচর ও জগদল ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে। এই বিদ্রোহী প্রার্থীরাই নৌকার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
৯ ইউপিতে জাসদের মশাল মার্কা নিয়ে ১, ইসলামি আন্দোলনের হাতপাখা নিয়ে ১ ও ১৫ জন বিএনপি এবং ১ জন জমিয়ত নেতা স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোটের লড়াইয়ে আছেন। ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে দিরাই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসায় নির্বাচন ঘিরে সরগরম দিরাই উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা। ভোটারদের মন জয়ে গণসংযোগ, পথসভা, ব্যস্ত সময় পার করছের প্রার্থীরা। বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থানে এমনটি বলা যাচ্ছে না।
রফিনগর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের প্রার্থী শৈলেন্দ্র কুমার তালুকদার। স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন মুখ শৈলেন্দ্র কুমারের বিরুদ্ধে ভোট করছেন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামীলীগ জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এছাড়া বিএনপির মো. বদরুল আলম ও আওয়ামীলীগের মো. আতিকুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান রেজুয়ার হোসেন খান।
ভাটিপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন আওয়ামীলীগের তিনজন শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী। এঁরা হলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান শাহজাহান কাজী, আওয়ামীলীগ নেতা বদরুল ইসলাম চৌধুরী মিফতাহ ও বিজিত চন্দ্র দাস।
রাজানগর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হলেন মো. সফিকুল হক তালুকদার। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন আওয়ামীলীগ নেতা নওশেরান চৌধুরী, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম। এ ইউনিয়নে ভোটের লড়াইয়ে আছেন বিএনপির মো. নুরুল আমিন, মো. রানা মিয়া ও রুনু মিয়া সর্দার।
চরনারচর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান জগদীশ সামন্ত। তাঁর বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন পরিতোষ রায়। এ ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের পরেশ লাল রায়, তুরাব আলী, বিএনপির শামসুল আলম তালুকদার ও গণমাধ্যম কর্মী রুকনুজ্জামান জহুরী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন।
জগদল ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামীলীগের উপ-প্রচার সম্পাদক হুমায়ুন রশীদ লাভলু। তাঁর শক্তিশালী প্রতিপক্ষ উপজেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান শিবলী আহমেদ বেগ। এছাড়া আওয়ামীলীগের আব্দুল বাছিত, ইসলামি আন্দোলনের মো. জহিরুল ইসলাম, জমিয়তের ইমদাদুল হক আরকান, বিএনপির তোফায়েল আহমদ প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আছেন।
করিমপুর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের প্রার্থী লিটন চন্দ্র দাস। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে ভোটে আছেন মো. সিজিল মিয়া। এ ইউনিয়নে বিএনপির একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন। এঁরা হলেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সেলিম সরদার, আতাউর রহমান বাদশা। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির তপু দাস প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন।
দিরাই সরমঙ্গল ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী রঞ্জিত রায়। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী, কানু লাল দাস, সেলিম মিয়া ও তপন কান্তি তালুকদার। এছাড়া বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন এবং জাসদের কৃষ্ণ কান্ত রায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন।
তাড়ল ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের প্রার্থী মো. আহম্মদ চৌধুরী। বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন, তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান আকিকুর রেজা, বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কুদ্দুস ও আওয়ামীলীগ নেতা মো. লাল মিয়া। প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন বিএনপির সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল হক তালুকদার, ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আলী আহমেদ।
কুলঞ্জ ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হলেন, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মিলন মিয়া। আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন, পবিত্র মোহন দাস, মো. একরার হোসেন, মো. আলাউর রহমান, চাঁন মিয়া চৌধুরী, আবু সালেহ। বিএনপি নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান ও মো. আনহার মিয়া রয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বীতায়।
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবেক এমপি আলহাজ্ব মতিউর রহমান বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে আওয়ামীলীগ। দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছেন এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের উস্কানি দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, আমাদের নেতারাই বিদ্রোহী প্রার্থীদের লালন করতেছে। দিরাইয়ে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ৩দিনের সময় দিয়ে শোকজ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হবে।