সারাদেশ

এমপি আনারকে আধা ঘণ্টায় হত্যা : সংবাদ সম্মেলনে ডিবি

► মরদেহ টুকরা করে ট্রলি ব্যাগে ভরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে ► ভারতীয় গোয়েন্দাদল ঢাকায় ► বিভ্রান্ত করতে এমপির মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ পাঠানো হয়

নিউজ ডেস্কঃ

ভারতের কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের বাসায় প্রবেশের পর মাত্র আধাঘণ্টায় খুন করা হয় ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে। তিন মাস আগে ঢাকায় হত্যার ষড়যন্ত্র করে  কলকাতার ওই বাসায় তা বাস্তবায়ন করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মহানগর ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ডিবিপ্রধান জানান, ঘটনায় জড়িত গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য পেয়েছেন তাঁরা। মূল হত্যাকারীসহ গ্রেপ্তার তিনজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ডিবিপ্রধান জানান, কলকাতায় এক বাসায় আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা করা হয়। এরপর হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে সেগুলো ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়। তবে মরদেহের টুকরাগুলো কোথায় ফেলা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

অন্তত দু-তিন মাস আগে আনার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন তাঁর বাল্যবন্ধু ও ব্যাবসায়িক অংশীদার আখতারুজ্জামান শাহীন। এই তথ্য জানিয়ে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ১৩ মে দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে কলকাতার ওই বাসায় প্রবেশ করেন আনার। এর ৩০ মিনিটের মধ্যে শাহীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার কাজটি করেন নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান ওরফে শিমুল। ঢাকার গুলশান ও বারিধারা এলাকার দুটি বাসায় হত্যার পরিকল্পনা করলেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তাঁরা হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতে কলকাতাকে বেছে নেন। তিনি বলেন, মূল হোতা আখতারুজ্জামান শাহীন এমপি আনারের ছোটবেলার বন্ধু। ঘটনার পর তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তাঁকে গ্রেপ্তারে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেওয়া হবে।

ডিবি জানায়, কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত ছক এঁকে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন। ঘটনার দিন আমানসহ ছয়জন মিলে এমপি আজীমকে প্রথমে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন।

পরে মরদেহ টুকরা করে ট্রলি ব্যাগে ভরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডিবিপ্রধান বলেন, ‘হত্যাকারীরা এমনভাবে লাশ গুমের চেষ্টা করেছে, যাতে কোনো হদিস না মেলে। লাশ গুমের জন্য হাড্ডি থেকে মাংস আলাদা করে ভিন্ন ভিন্ন ট্রলিতে করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেউ যাতে বুঝতে না পারে, এ জন্য মাংসে মসলা  মেশানো হয়।’

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘সংসদ সদস্য আনারের মরদেহ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে মরদেহের অংশবিশেষ পাওয়া যেতে পারে। আমরা ভারতের পুলিশের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ রাখছি।’

যেভাবে হত্যা করা হয়

গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনারকে হত্যার আগে ঢাকার গুলশান ও বারিধারার দুটি বাসায় একাধিকবার আলোচনা করেন খুনিরা। প্রথমে তাঁরা দেশেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরে ডিবির তদন্ত সক্ষমতার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত পাল্টান। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ২৫ এপ্রিল তাঁরা কলকাতায় বাসা ভাড়া করেন। আখতারুজ্জামান, তাঁর বান্ধবী ও আমান উল্লাহ গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে বিমানে করে কলকাতায় গিয়ে সেই বাসায় ওঠেন। বান্ধবী শিলাস্তিকে সঙ্গে নিয়ে মূলত পরিবার নিয়ে থাকার তথ্য দিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেন আখতারুজ্জামান। এমপিকে হত্যা করতে তাঁরা প্রথমে স্থানীয় দুজনকে ঠিক করেন। তাঁরা হলেন জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়াম। হত্যার পরিকল্পনাকারী শাহীন হত্যার পর কোন গাড়ি ব্যবহার করা হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে, সেগুলো ঠিক করে ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

এমপি আনার কলকাতায় গিয়ে প্রথমে তাঁর বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। এই তথ্য জানিয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, সেখান থেকে শাহীনের ঠিক করা একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাঁকে নিয়ে যান। কিছুদূর যাওয়ার পর আমান উল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠেন। চালক ছিলেন রাজা। সেই বাসায় (নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন) যাওয়ার পর মোস্তাফিজসহ তাঁরা বাসায় প্রবেশ করেন। বাসায় আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবস্থান করছিলেন। দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে এমপি আনার ওই বাসায় যান। প্রবেশের আধাঘণ্টার মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আমান উল্লাহ ছদ্মনাম, তাঁর আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া—এ তথ্য জানিয়ে ডিবিপ্রধান হারুন বলেন, তিনি নিষিদ্ধ সগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। বর্তমানে আমানউল্লাহ ও শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমানসহ তিনজন ডিবি হেফাজতে আছেন। তাঁদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা জানা গেছে বলে জানান হারুন অর রশীদ।

হারুন অর রশীদ বলেন, হত্যার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা গেছে, হত্যাকারীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করতে নিহত সংসদ সদস্যের দুটি মোবাইল ফোন দুই দিকে নিয়ে যান। এরপর তাঁরা বিভিন্নজনকে বার্তা পাঠান এবং কল করতে থাকেন। তিনি জীবিত আছেন, এটা বোঝানোর জন্য এটা করা হয়।

তদন্তে ভারতীয় গোয়েন্দাদল ঢাকায়

এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তিন সদস্যের দল ঢাকায় পৌঁছেছে। গতকাল দুপুরে ডিবিপ্রধান সাংবাদিকদের এই তথ্য দেন। তিনি বলেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতীয় স্পেশাল পুলিশের একটি টিম ডিবি কার্যালয়ে এসেছে। এমপি আজীম হত্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে ডিবি ওয়ারী বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে।

ঘটনার সময় দেশে ছিলাম : শাহীন

এমপি আনারকে হত্যার সময় ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আখতারুজ্জামান শাহীন বাংলাদেশে থাকার কথা দাবি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচারিত বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এমন দাবি করেন।

মরদেহের অংশ গুমে ব্যবহৃত গাড়ি জব্দ

এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ বহনে ব্যবহৃত সাদা রঙের একটি গাড়ি গতকাল ভোরে জব্দ করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। একই দিন এই হত্যার ঘটনায় কলকাতার নিউ টাউনে সিয়াম নামের এক যুবককে আটক করেছে সিআইডি। ১৩ মে তিনি নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় জুবের নামের এক ক্যাবচালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ

এমপি আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় ৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল এই মামলার এজাহার আদালতে আসে। সেই এজাহার আমলে নিয়ে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ  ব্যাপারে পুলিশকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

কে এই শিলাস্তি রহমান

কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনসের বি ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয়টি ডিবিকে প্রথমে জানান শিলাস্তি রহমান। তাঁর বাসা উত্তরা এলাকায়। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিভিন্ন সময়ে তিনি আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে দেশের বাইরে গেছেন। হত্যার সময় তিনি কলকাতার ওই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। শিলাস্তি রহমান গত ১৫ মে আমান উল্লাহর সঙ্গে বিমানে করে দেশে ফেরেন। সুত্রঃ  কালের কন্ঠ

Related Articles

Back to top button
Share via
Copy link
Powered by Social Snap